
গাজীপুরের কাশিমপুরের হাইসিকিউরিটি কারাগারে বসেই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা হয়। কারাগারের মধ্যেই স্মার্টফোন ব্যবহার করেছে জঙ্গিরা। সেখান থেকে দলের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হয় গত রবিবার। পরিকল্পনা মতো দুই জনকে ছিনিয়ে নিতে পারলেও বাকি দুই জনকে নিতে পারেনি। গতকাল সোমবার কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটিটিসি) কর্মকর্তারা কাশিমপুরে গিয়ে আটক থাকা জঙ্গিদের সঙ্গে কথা বলেছে। পাশাপাশি যে দুই জন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিতে পারেনি তারা এখন পুলিশ রিমান্ডে আছে। তাদের কাছ থেকেই এসব তথ্য নিশ্চিত হয়েছেন সিটিটিসির কর্মকর্তারা।
রবিবার আদালত চত্বর থেকে পুলিশ জঙ্গিদের ব্যবহার করা যে মোটরসাইকেলটি উদ্ধার করেছে সেটি গত মে মাসে ভুয়া এনআইডি দিয়ে কেনে জঙ্গিরা। ঢাকা মেট্রো-ল-৩১-৫৭১০ নম্বরের ঐ মোটরসাইকেলটি ১৬০ সিসির হোন্ডা ব্র্যান্ডের হরনেট মডেলের। মোটরসাইকেলটির নিবন্ধন হাসান আল মামুন নামে এক যুবকের নামে। তিনি পুরান ঢাকার বাসিন্দা। গতকাল তাকে সিটিটিসির কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, গত মে মাসে বিক্রয় ডটকমের মাধ্যমে আতিকুজ্জামান নামে এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেন। পুলিশ আতিকুজ্জামানকে খুঁজতে গিয়ে দেখে, তার এনআইডি, ছবি সবকিছুই ভুয়া। এমনকি মালিকানাও তারা বদল করেনি।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজমের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার হামলায় নেতৃত্ব দেওয়া প্রধান ব্যক্তিকে তারা শনাক্ত করেছেন। খুব সহসাই তাকে গ্রেফতারের ব্যাপারে আশাবাদী কর্মকর্তারা। এদিকে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে পাঁচ পুলিশ সদস্যকে সাসপেন্ড করেছে পুলিশ সদর। পাশাপাশি একজন ডিআইজির নেতৃত্বে আরেকটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে। কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলেছে।
কাউন্টার টেররিজমের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘কারাগারের মধ্যে জঙ্গিরা কীভাবে স্মার্টফোন ব্যবহার করল সেটাও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে পাওয়া আলামত থেকে বোঝা যাচ্ছে, গত মে মাসেই তারা এই পরিকল্পনা করেছে। সেটার বাস্তবায়নের জন্য মোটরসাইকেলও কেনে। পাশাপাশি জঙ্গিদের আদালতে আনা-নেওয়ার পর ও কোর্ট চত্বরকে তারা দীর্ঘ মনিটরিং করেছে। কোর্ট চত্বরকেই তারা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য অপেক্ষাকৃত সহজ বলে মনে করেছে।’ জঙ্গিদের হ্যান্ডেল করার ক্ষেত্রে কিছু অবহেলা ছিল বলে স্বীকার করেন তিনি।
সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, রবিবার আদালত থেকে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তির নাম আমরা পেয়েছি। তাকে শনাক্ত করা হয়েছে। তার সঙ্গে আরো কারা কারা ছিল এরকম বেশ কয়েক জনের নাম আমরা পেয়েছি। কিন্তু এই মুহূর্তে তদন্তের স্বার্থে ব্যক্তির নাম-পরিচয় আমরা বলতে চাচ্ছি না। জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা কীভাবে হয়েছে সেটাও আমরা গোয়েন্দার মাধ্যমে জানতে পেরেছি। পরিকল্পনা ও অপারেশনে কারা কারা ছিল এরই মধ্যে গোয়েন্দা তথ্যে আমরা নিশ্চিত হতে পেরেছি। তাদের যত দ্রুত সম্ভব গ্রেফতার করা আমাদের মূল লক্ষ্য। জঙ্গিদের টার্গেট শুধু চার জনই ছিল না কি আরো জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার টার্গেট ছিল, এমন প্রশ্নের জবাবে আসাদুজ্জামান বলেন, চার জনকে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল তবে দুই জনকে তারা নিয়ে যায়। প্রথমে চার জন নেমেছে, তাদেরই তারা নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। যদি একসঙ্গে বেশি নামতো তাদেরও নিয়ে যেত হয়তোবা, এমন পরিকল্পনা থাকতে পারে।
সিটিটিসি প্রধান আরো বলেন, আদালতে হাজিরা দিতে আসেন আনসার আল ইসলামের শীর্ষ পর্যায়ের জঙ্গিরা। প্রত্যেক আসামিই জঙ্গি সংগঠনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সব সদস্যকে সিটিটিসি ২০১৬ সালে গ্রেফতার করেছিল। গ্রেফতারের মাধ্যমে তাদের বেশকিছু অপারেশন ও হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচিত ও উদ্ঘাটিত হয়েছিল। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা প্রত্যেকটা পয়েন্টকে সতর্ক করে দিয়েছি। যেন করে পলাতক জঙ্গিরা পালিয়ে যেতে অথবা কোনোভাবে দেশত্যাগ করতে না পারে।
সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়াকে নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান বলেন, অপারেশনের নেতৃত্ব জিয়া দেননি। যে অপারেশনের নেতৃত্ব দিয়েছে তাকে আমরা শনাক্ত করেছি। জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় নতুন জঙ্গি সংগঠনের সম্পৃক্ততা আছে কি না এমন এক প্রশ্নের জবাবে আসাদুজ্জামান বলেন, নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম, জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যদের নিয়ে নতুন জঙ্গি সংগঠনটি তৈরি হয়েছে। এখানে নতুন জঙ্গি সংগঠনের সম্পৃক্ততা নেই।
যে চার জনকে জঙ্গিরা ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করে তার মধ্যে মো. আরাফাত রহমান (২৪) ও মো. আ. সবুর ওরফে রাজু ওরফে সাদ ওরফে সুজনকে (২১) নিতে পারেনি। তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন সিটিটিসির কর্মকর্তারা। ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনার বিষয়ে তারাও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। এদিকে দুই জঙ্গি পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় করা মামলার তদন্তভার পেয়েছে সিটিটিসি। ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল থেকে জঙ্গি ছিনতাইয়ের মামলার তদন্তভার কোতোয়ালি থানা থেকে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) বিভাগে হস্তান্তর হয়েছে।
এদিকে এই ঘটনার তদন্তে পুলিশ সদর থেকে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) মো. মনজুর রহমান বলেন, পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অডিট) মো. আমিনুল ইসলামকে প্রধান করে কমিটির সদস্যসচিব করা হয়েছে অতিরিক্ত ডিআইজি (ক্রাইম মেট্রো) মো. হাসানুজ্জামানকে। কমিটির সদস্যরা হলেন সিটিটিসির ড. এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মেট্রো সাউথ) মো. আনিচুর রহমান। এর আগে রবিবার ঘটনার পরপর ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনারকে সভাপতি করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ডিএমপি।
মহানগর পুলিশের অপরাধ তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের উপ-কমিশনার জসীম উদ্দীন বলেন, দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে সিএমএম আদালতের হাজতখানার কোর্ট ইন্সপেক্টর মতিউর রহমান, হাজতখানার ইনচার্জ এসআই নাহিদুর রহমান, আসামিদের আদালতে নেওয়ার দায়িত্বে থাকা পুলিশের এটিএসআই মহিউদ্দিন, কনস্টেবল শরিফুল হাসান ও কনস্টেবল আব্দুস সাত্তারকে সাসপেন্ড করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত রবিবার দুপুরে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রাঙ্গণ থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় জঙ্গিরা। এ সময় আরাফাত ও সবুর নামে আরো দুই জনকে ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করে জঙ্গিরা। পরে ঘটনাস্থল থেকে আরাফাত ও সবুরকে আটক করা হয়। এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় কোর্ট পরিদর্শক জুলহাস বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয় আরো সাত-আট জনকে।