ঢাকা, শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ব্যর্থ হওয়ার পথে পাকিস্তান?

সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের তীব্র উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতি দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই বিশ্ব পরিমণ্ডলেও আলোচনার জন্ম দিয়েছে। দেশটির এ হাল কেন তা বুঝতে হলে তার অতীত ইতিহাস জানাটা জরুরি। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীন হওয়ার পর দীর্ঘ ৯ বছর লাগিয়ে দেয় পাকিস্তান একটি সংবিধান তৈরি করতে।

রাষ্ট্রভাষা এবং শাসনক্ষমতার প্রশ্নে হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণে দেশের একটি বড় অংশ পূর্ব পাকিস্তানকে (বর্তমান বাংলাদেশ) হারিয়ে বসে ১৯৭১ সালে। এর আগে এবং পরে পাকিস্তানের ইতিহাসে সরাসরি সেনাশাসন চলেছে প্রায় অর্ধেক সময়। এসব মিলিয়ে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক যাত্রা কখনোই মসৃণ ছিল না; বরং ক্রমেই জটিল হয়ে ওঠেছে।

রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের আজকের অবস্থানে আসার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ বোধ হয় বিচার বিভাগ, আমলাতন্ত্র, এলিট রাজনীতিবিদ, ধর্মীয় নেতা এবং কর্পোরেট সেক্টরে শীর্ষস্থানীয়রা মিলে গড়ে তোলা এস্টাবলিশমেন্ট। এ এস্টাবলিশমেন্টের সবচেয়ে বড় অংশীদার বা নিয়ন্ত্রক যাই বলা হোক না কেন, তা হলো পাকিস্তান সেনাবাহিনী। মূলত দেশের রাজনীতির মূল নিয়ন্ত্রক এ সেনাবাহিনী। এস্টাবলিশমেন্টের বাকি অংশ মূলত সেনাবাহিনীরই ক্রীড়নক।

১৯৪৭ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ছয় দশকে অর্ধেকেরও বেশি সময় অর্থাৎ ৩৩ বছর সরাসরি পাকিস্তান ছিল সেনাশাসনের আওতায়। এর পর থেকে দেশটির রাজনৈতিক নেতারা শাসনব্যবস্থায় সেনাবাহিনীর অবস্থানকে কমিয়ে আনার ব্যাপারে কিছুটা হলেও সফল হয়েছিলেন বলা যায়। কিন্তু পুরোপুরি তো দূরে থাক আংশিকভাবেও তারা রাজনীতিকে সামরিক বাহিনীর আওতামুক্ত করতে পারেননি। ২০০৮ সালের পর থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে দেশটিতে ৬ জন প্রধানমন্ত্রী সরকার গঠন করেছেন। কিন্তু কোনো সরকারই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি।

কোনো সরকারই মেয়াদ পূর্ণ করতে না পারার পেছনে মূলত সেনা নিয়ন্ত্রণাধীন এস্টাবলিশমেন্টই দায়ী। ২০০৭ সালের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী সরাসরি ক্ষমতা থেকে চলে গেলেও খুব দ্রুতই আবার রাজনীতিতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার কৌশল রপ্ত করে নেয়। সেই থেকে ২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সেনাবাহিনী নেপথ্যে থেকে চাল চাললেও সে বছর এপ্রিল মাসে ইমরান খানের ক্ষমতাচ্যুতির পর সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক পাশার ছক উল্টে যায়।

আরও পড়ুন: পাক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ইমরানের ১০০০ কোটি রুপির মানহানি মামলা

ইমরান খান প্রকাশ্যভাবে সেনাবাহিনীকে দায়ী করতে থাকেন তার ক্ষমতাচ্যুতির জন্য। ইমরান খানের সেনাবিরোধী অবস্থান সমাদৃত হয় দেশজুড়েই। তার দলের নেতাকর্মীরা তো বটেই সাধারণ মানুষও সেনাবাহিনীর এতদিনের প্রাধান্যের বিরোধিতা করতে শুরু করেছেন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে রাজনীতিবিদদের দ্বিচারিতার বিষয়টি নতুন নয়।

এর একটি উদাহরণ হলো, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও তার দল যখন বিরোধী দলে ছিল তখন তারা নামকাওয়াস্তে সেনাবাহিনী ও এস্টাবলিশমেন্টের সমালোচনা করলেও ক্ষমতায় এসে তারা একেবারে চুপ এবং সেনাবাহিনীর হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মিলিয়েই চলছে।

কিন্তু আল কাদির ট্রাস্ট মামলায় ইমরান খানের গ্রেফতারের পর বিষয়টি কেবল আর রাজনীতিবিদদের মধ্যে নেই। সেনাবাহিনীর রাজনীতিতে হস্তক্ষেপমূলক কর্মকাণ্ড দেশবাসীর মনে রাগ-ক্ষোভের উদ্রেক করেছে। যার প্রমাণ পাওয়া যায়, ইমরান খানের গ্রেফতারের পর বিক্ষোভ মিছিল, সেনা সদর দফতরে এবং কর্পস কমান্ডারদের বাসভবনে হামলার ঘটনা থেকে। ইমরান খান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যে শীতল ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ শুরু করেছিলেন, তা এখন স্পষ্টতই রূপ নিয়েছে উত্তপ্ত সহিংসতায়।

আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, সেনাবাহিনীও বেশ সহিংস উপায়েই বিক্ষোভ আন্দোলন দমনের পথ বেছে নিয়েছে। তারা ঘোষণা দিয়েছে, সেনা আইনে ভাঙচুরকারীদের বিচার করা হবে। তবে এই বিষয়টি দেশটির বিচার বিভাগ এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে দূরত্ব আরও বাড়াতে পারে। ইমরান খানের গ্রেফতারের পর দেশটির সর্বোচ্চ আদালত একটি স্বাধীন অবস্থান গ্রহণ করে এবং ইমরান খানের গ্রেফতারকে অবৈধ বলে ঘোষণা দিয়ে তাকে মুক্তি দেয়ার আদেশ দেয়। নিশ্চয়ই আদালতের এই আদেশ সেনাবাহিনীর মনঃপুত হয়নি।

এ থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগ আপাতত একটি দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে। এটি অবশ্যই ইমরান খানের জন্য ইতিবাচক ফলাফল বয়ে এনেছে। যাইহোক, সেনাবাহিনী যদি সেনা আইনে বিচার করে এবং শাস্তি দেয় সেক্ষেত্রে তা দেশটির বেসামরিক সরকার ও বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা তৈরি করবে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সেনাবাহিনীর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব আরও উসকে দেবে।

এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, সেনাবাহিনীর শীর্ষ জেনারেলদের মধ্যে অনৈক্য। যা সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে আরও কমিয়ে ফেলতে পারে। তবে সেনাবাহিনীর দাবি, শীর্ষ জেনারেলদের মধ্যে কোনো অনৈক্য নেই। তবে অনৈক্য থাক বা না থাক, সেনাবাহিনীকে যদি সরাসরি জনগণের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় তবে তাতে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনীর দক্ষতায় মরচে ধরতে পারে। যা তার কার্যক্রম পরিচালনাকে প্রভাবিত করতে পারে নেতিবাচকভাবে।

সুতরাং, ইমরান খানের ক্ষমতাচ্যুতি, গ্রেফতার ও তৎপরবর্তী ঘটনাবলী পাকিস্তানকে একটি বাঁকের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। যেখান থেকে নির্ধারিত হবে পাকিস্তান কোন দিকে যাবে। তবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো সন্ত্রাসবাদ। বিগত শতকের ’৯০-এর দশক থেকে মূলত পাকিস্তানি সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলোর উত্থান হতে থাকে।

তখন আফগানিস্তানে লড়াইরত সোভিয়েত আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করত এসব গোষ্ঠী। আফগান মুজাহিদরা দেশটি থেকে রুশ বাহিনীকে চলে যেতে বাধ্য করলে সেই সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বেড়ে যায়। বর্তমানে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধে শামিল হওয়ার পর থেকেই পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা বেড়ে গেছে।

পাকিস্তানের এস্টাবলিশমেন্ট ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তারা নিজেদের প্রয়োজনে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলোকে অর্থায়ন করেছে। এসব গোষ্ঠীর একটিকে অপরটির বিরুদ্ধে লড়িয়েছে। কিন্তু তাতে আখেরে পাকিস্তানের কোনো লাভ হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়নি।

কিন্তু বর্তমান সময়ে এসেও পাকিস্তান সেনাবাহিনী কিংবা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের অভিযোগ মুছে ফেলতে পারেনি। পাকিস্তানের বেলুচিস্তান এবং খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করা যায়নি। বরং তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসার পর তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান বা টিটিপির মতো সংস্থাগুলো সন্ত্রাসী হামলার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

সন্ত্রাসবাদের পাশাপাশি পাকিস্তানের জন্য আরেকটি বড় সমস্যা হলো বেলুচিস্তান, খাইবার পাখতুনখাওয়া এবং গিলগিট বাল্টিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো। পার্বত্য এলাকা হওয়ার কারণে স্থানীয়দের সঙ্গে ট্র্যাডিশনাল সেনাবাহিনী কখনোই রণকৌশলে পারেনি। ২০০৭ সালের দিকে পাকিস্তানের তৎকালীন শাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফ বিদ্রোহ দমনে সেনাবাহিনী পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হয়নি।

আরও পড়ুন: সামরিক স্থাপনায় সহিংসতার প্ররোচনা মামলায় ইমরানের জামিন

এর বাইরে ভূরাজনৈতিক দিক থেকেও পাকিস্তান অস্থিতিশীল দেশ। দেশটিতে ক্ষমতার পালাবদল এত দ্রুত হয় যে, তাতে বিদেশি অংশীদারদের পক্ষে তাল মেলানো সহজ হয় না। পাকিস্তান ভূরাজনৈতিক দিক থেকে ওয়াশিংটন এবং বেইজিং উভয়ের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সম্পর্কের বদলে দুটি দেশই সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। যা দেশটির গণতন্ত্র তো বটেই দেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যও ক্ষতিকর। নানা কারণেই পাকিস্তান অর্থনৈতিক সংকটে ডুবে রয়েছে। রাজনৈতিক সংকট সেই অর্থনৈতিক সংকটকে আরও গভীর করছে।

সব মিলিয়ে বলা যায়, পাকিস্তানের আজকের রাজনৈতিক দুরবস্থার কারণ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে শাসনক্ষমতায় সেনাবাহিনীর মাধ্যমে কথিত এস্টাবলিশমেন্টের নিয়ন্ত্রণ। ইমরান খানের রাজনৈতিক চাল সেনাবাহিনীকে ১৯৭০-৭১ সালের আবারও জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। পাকিস্তানের জনগণ, গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য রাজনীতি এবং শাসনক্ষমতা থেকে সেনাবাহিনী তথা এস্টাবলিশমেন্টের নিয়ন্ত্রণ সরানো জরুরি। যদিও সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া তার বিদায়ী ভাষণে বলেছিলেন, সেনাবাহিনী নিজেদের রাজনীতি থেকে দূরে রাখবে। কিন্তু বাস্তবে তা হতে দেখা যায়নি।

বর্তমানে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পাকিস্তানে সেনাবাহিনী, রাজনীতিবিদ, বিচার বিভাগ এবং জনগণ পরস্পরের ওপর আস্থার সংকটে ভুগছে। যা আখেরে দেশটির গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা এবং সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ করবে। ফলে শিগগিরই যদি এই সংকট দূর করা সম্ভব না হয় তবে পাকিস্তানের গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো আরও কম কার্যকর হয়ে উঠবে। যার চূড়ান্ত মাশুল দিতে হবে সে দেশেরই জনগণকে এবং চূড়ান্ত পরিণামে রাষ্ট্র হিসেবে ব্যর্থ হিসেবেও পরিগণিত হতে পারে।