ঢাকা, শনিবার, ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাক্ষীরা বলছেন ডাকা হয় না, রাষ্ট্রপক্ষ ‘খুঁজে পাওয়া যায় না’

রাজধানীর অদূরে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলাটির আট বছরেও কোনো কূলকিনারা হয়নি। আলোচিত মামলাটির সাক্ষীদের বিরুদ্ধে আদালতের ‘জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা’ জারি রয়েছে। এরপরও তাদের আদালতে উপস্থিত করা যাচ্ছে না।

অগ্নিকাণ্ডে আহত শ্রমিকরা বলছেন, মামলার বিষয়ে তাদের কেউ কিছু জানায় না। সাক্ষ্য দিতে ডাকা হয় না। ডাকলে অবশ্যই সাক্ষ্য দিতে যেতাম। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষীদের আদালতে উপস্থিত করছেন না। সাক্ষী আদালতে উপস্থিত না হওয়ায় মামলাটির বিচার কার্যক্রম দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে।

ঢাকার আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের অষ্টম বার্ষিকী মঙ্গলবার। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন লেগে ১১২ জন শ্রমিক নিহত হন। আহত হন অন্তত ২০০ শ্রমিক। নিহত শ্রমিকদের অনেকেরই পরিচয় নিশ্চিত হতে না পেরে তাদের মরদেহ অজ্ঞাতনামা হিসেবে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। পরবর্তী সময়ে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে অনেকের মরদেহ শনাক্ত করে তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

আলোচিত ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলার বিচারকাজ চলছে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে। মামলাটির বিচারকাজ শুরু হওয়ার পর পাঁচ বছর পার হয়েছে। পাঁচ বছরে ১০৪ সাক্ষীর মধ্যে সাক্ষ্য দিয়েছেন মাত্র আটজন। রাষ্ট্রপক্ষ দাবি করছে, সাক্ষীদের বর্তমান ঠিকানায় অধিকাংশকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যেসব সাক্ষীর স্থায়ী ঠিকানা দেয়া হয়েছে তারা সঠিকভাবে আদালতের সমন পাচ্ছেন না।

ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল মান্নান খান বলেন, ‘তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মামলার অভিযোগপত্রে অধিকাংশ সাক্ষীর বর্তমান ঠিকানা দেয়া হয়েছে। তবে বর্তমান ঠিকানায় অনেককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যেসব সাক্ষীর স্থায়ী ঠিকানা দেয়া হয়েছে, তারা সঠিকভাবে আদালতের সমনও পাচ্ছেন না। তাদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরও পুলিশ তাদের গ্রেফতার করছে না।’

 

অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত তাজরীন ফ্যাশনসের কারখানা

‘সাক্ষীরা বলছেন, তাদের আদালতে ডাকা হয় না’— এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সাক্ষীরা যে অভিযোগ করেছেন, তা সত্য নয়। আদালত সাক্ষীদের সাক্ষ্য দিতে সমন জারি করেছেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার উচিত সাক্ষীদের আদালতে উপস্থিত করানো।’

তাজরীন ফ্যাশনসের মালিক দেলোয়ার হোসেনের আইনজীবী এ টি এম গোলাম গাউস বলেন, ‘আলোচিত মামলাটিতে সাক্ষীরা আদালতে উপস্থিত হন না। রাষ্ট্রপক্ষের উচিত সাক্ষীদের আদালতে উপস্থিত করানো।’

তিনি আরও বলেন, ‘সাক্ষী হাজির না হওয়ায় মামলাটি গতি পাচ্ছে না। আমরা চাই, মামলাটি যেন দ্রুত শেষ হয়। ন্যায়-অন্যায় আদালতের মাধ্যমে প্রমাণিত হবে। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় আমরা অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে আছি। আমরা ঠিকভাবে ব্যবসাও পরিচালনা করতে পারছি না। রাষ্ট্রপক্ষের উচিত, মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করা।’

তাজরীন ফ্যাশনসের সুইং অপারেটর ছিলেন মোছাম্মত জরিনা। ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ড থেকে প্রাণ বাঁচাতে কারখানার তিন তলা থেকে নিচে লাফ দেন। পঙ্গুত্বের সঙ্গে এখন তার বসবাস।  তিনি বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের দিন আমি তাজরীন ফ্যাশনসের পাঁচ তলায় কাজ করছিলাম। পৌনে ৭টার দিকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। আমি বের হতে চাইলে সিকিউরিটি আল-আমিন বের হতে দেয়নি। সে গেটে তালা মেরে দেয়। আমি তিন তলায় আটকা ছিলাম। আগুন বেড়ে গেলে জানালা দিয়ে লাফ দেই। আমার ডান পা ও ঘাড়ের হাড় ভেঙে যায়। আট বছর ধরে কোনো কাজ করতে পারি না। আমার পাশে যারা ছিল তাদেরও একই অবস্থা। আমরা কোনো ক্ষতিপূরণও পাইনি। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে অনেক কষ্টে জীবন পার করছি।’

 

অগ্নিকাণ্ডে নিহত স্বজনদের আহাজারি

তিনি আরও বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তাজরীন ফ্যাশনসের মালিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলায় আমাদের সাক্ষী করা হয়েছে। মামলার বিষয়ে আমাদের কেউ জানায় না। সাক্ষীর জন্যও আমাদের ডাকে না। এখন তাজরীনের মালিক জামিন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা সরকারের কাছে এর ন্যায়বিচার চাই। আমরা শ্রমিক হত্যার বিচার চাই। আমাদের আর কোনো শ্রমিককে যেন আগুনে পুড়ে মরতে না হয়।’

একই অভিযোগ অগ্নিকাণ্ড থেকে বেঁচে ফেরা তাজরীন ফ্যাশনসের কর্মী নাজমা আক্তারের। তিনি বলেন, ‘আমি অগ্নিকাণ্ডের পাঁচদিন আগে কাজে যোগ দেই। অগ্নিকাণ্ডের সময় চার তলার এক রুমে বন্দি ছিলাম। আমার পায়ের কাছে আগুনে পুড়ে যাওয়া লাশ ছিল। আমি তখন চার তলা থেকে লাফ মারি। এতে আমার শরীরের ডানপাশ অচল হয়ে যায়। ওই ঘটনায় মামলা হয়। কিন্তু মামলার কোনো বিষয়ে আমাদের জানানো হয় না। সাক্ষীর জন্য আমাদের আদালতেও ডাকা হয় না। আমরা শ্রমিক হত্যার ন্যায়বিচার চাই।’

তাজরীন ফ্যাশনসের ক্ষতিগ্রস্ত কর্মী লুৎফা বেগমের বক্তব্যও একই। তিনি বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের দিন আমি কারখানার ভেতরে ছিলাম। চোখের সামনে অনেক মানুষকে মরতে দেখেছি। ওই সময়ের কথা মনে হলে এখনও ঘুম হয় না। কারখানার মালিক দেলোয়ারের বিরুদ্ধে মামলায় হয়। মামলায় সাক্ষ্য দিতে আমাকে কেউ ডাকে না। সাক্ষী দিতে ডাকলে আমি অবশ্যই যেতাম।’

মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১১২ জন মারা যান। আহত ও দগ্ধ হন দুই শতাধিক শ্রমিক। ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ডের পরদিন আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) খায়রুল ইসলাম বাদী হয়ে অজ্ঞাত পরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। সেই মামলায় নাশকতার পাশাপাশি অবহেলাজনিত মৃত্যুর দণ্ডবিধির ৩০৪ (ক) ধারা যুক্ত করা হয়।

 

তাজরীন ফ্যাশনসের মালিক দেলোয়ার হোসেন

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক এ কে এম মহসিনুজ্জামান খান ২০১৩ সালের ২২ ডিসেম্বর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিজিএম) আদালতে তাজরীন ফ্যাশনসের এমডি দেলোয়ার হোসেনসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন। ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান। মামলায় ১০৪ সাক্ষীর মধ্যে বিভিন্ন সময় আটজনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে।

মামলার আসামিরা হলেন- প্রতিষ্ঠানের মালিক দেলোয়ার হোসেন, চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার, লোডার শামীম, স্টোর ইনচার্জ (সুতা) আল-আমিন, সিকিউরিটি ইনচার্জ আনিসুর রহমান, সিকিউরিটি সুপার ভাইজার আল-আমিন, স্টোর ইনচার্জ হামিদুল ইসলাম লাভলু, অ্যাডমিন অফিসার দুলাল উদ্দিন, প্রকৌশলী এম মাহবুবুল মোর্শেদ, সিকিউরিটি গার্ড রানা ওরফে আনোয়ারুল, ফ্যাক্টরি ম্যানেজার আব্দুর রাজ্জাক, প্রোডাকশন ম্যানেজার মোবারক হোসেন মঞ্জু ও শহীদুজ্জামান দুলাল।

আসামিদের মধ্যে মো. শহীদুজ্জামান দুলাল, মোবারক হোসেন মঞ্জু, মো. রানা ওরফে আনোয়ারুল, আল-আমিন ও মো. শামীম মিয়া এখনও পলাতক।