ঢাকা, বুধবার, ২৯শে নভেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৪ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনীতি

আল্লাহর সেরা সৃষ্টি মানবজাতি। পৃথিবীর সকল প্রাণীর মধ্যে মানুষ সেরা জীব। তাই মানব শরীরের স্বাস্থ্যও অতি গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান বিশ্বে মানুষের কাছে অর্থনীতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু মাবব শরীর বা মানুষের স্বাস্থ্য নিজেই একটি বড় অর্থনীতি যা অমূল্য। মানুষের সকল মৌলিক বিষয়ের গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি মানুষের স্বাস্থ্যকেও অতি মৌলিক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। সেজন্য মানুষের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য একই রকম স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে।

সমাজের অসাধু মানুষের জন্য আজ স্বাস্থ্যসেবা ব্যবসায় পরিনত হয়েছে। আল্লাহর সৃষ্টির সেরা মানুষের জীবন তথা স্বাস্থ্য নিয়ে ব্যবসা কোন মতেই সভ্য সমাজের কাজ নয়। মানুষের জীবিকার জন্য বা ব্যবসার জন্য বহু ক্ষেত্র রয়েছে। সে জন্য স্বাস্থ্য নিয়ে ব্যবসা অমানবিক। কোন দেশ কতটা উন্নত, সভ্য ও মানবিক হয়েছে সেটাও সার্বজনীন স্বাস্থ্য পরিসেবার উপর নির্ভরশীল।

মানুষের স্বাস্থ্যকে ঘিরে আজ বিশ্বব্যাপী বহু সিন্ডিকেট ব্যবসায় জড়িত। পৃথিবীর মানুষকে স্বাস্থ্যের বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হবে, ব্যবসাকে পরিহার করে সকল মানুষের স্বাস্থ্যসেবা তৈরির ব্যাপারে নতুন আঙ্গিকে পরিকল্পনা নিতে হবে। নতুন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে শুধুমাত্র স্বাস্থ্যসেবা সরকার ও অলাভজনব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকাটা বর্তমান বিশ্বে বাঞ্চনীয় বলে বিবেচিত হচ্ছে।

সরকার ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কিভাবে বিনামূল্যে অথবা নামমাত্র মূল্যে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায় এবং একইসঙ্গে স্বাস্থ্যসেবার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার লক্ষ্যে ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন। পৃথিবীর ধনী, দরিদ্র সকল শ্রেণির মানুষের একই রকমের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে ভাবতে হবে এবং নতুন করে আলোচনায় নিয়ে আসতে হবে।

ধনী দরিদ্রের বৈষম্য কমানোর জন্য যেমন ধনী দেশগুলোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে, তেমনি দরিদ্র দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য ধনী দেশগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষে এককভবে সক্রিয় কোন ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে না। বর্তমানে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় দরিদ্র দেশগুলোর দারিদ্র্য বিমোচন ও স্বাস্থ্যখাত উন্নয়নে কোন কার্যক্রর উল্লেখযোগ্য অবদান নেই।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ দারিদ্র্যের হার কমিয়েছে সে সকল দেশের একান্ত প্রচেষ্টা, মানবিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব, অলাভজনক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মানবিক সেবা ও দরিদ্র জনগণের শ্রমের দ্বারা; কোন আন্তর্জাতিক সংস্থার বিশেষ উদ্যোগে নয়। তাই দারিদ্র্য বিমোচন ও স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে এতোদিন যেসব নীতিমালাকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয়েছে সেসব বিষয়গুলো নতুন করে ভাবতে হবে। কারণ কোন কিছুই সার্বজনীন নয়, সময়ের প্রয়োজনে সবই পরিবর্তনশীল। সত্যিকারের দারিদ্র্য বিমোচন ও স্বাস্থ্যসেবার জন্য কোন বিশেষ মহলের স্বার্থ ছাড়াই উদ্ভাবনী ও জনকল্যাণমূলক পন্থা গ্রহণ করতে হবে।

রাষ্ট্রের নিরাপত্তার অংশ হিসেবে জনগণের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করে এটিকে সর্বোচ্চ সেবাখাত হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। স্বাস্থ্য নিরাপত্তা না থাকলে অর্জিত অর্থনীতি বালির বাধের মতো যেকোন সময় ভেঙ্গে পড়তে পারে। তাই রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়নে স্বাস্থ্যকে সর্বোচ্চ সেবাখাত হিসেবে বিবেচনা করে দারিদ্র্য বিমোচন, কৃষি, কর্মসংস্থান, নারী ও শিশুর উন্নয়নে গুরুত্ব দিতে হবে। স্বাস্থ্যনিরাপত্তাকে জাতীয় অর্থনীতির শক্তিশালী নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করে অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে হবে।

সমাজে যদি হিংসা-বিদ্বেষের চর্চা করা হয়, তাহলে সমাজে হিংসা-বিদ্বেষ বৃদ্ধি পাবে। তাই একটি সুন্দর মানবিক সমাজ গঠনের জন্য হিংসা-বিদ্বেষ মুক্ত সমাজ গঠনের জন্য ভাল কাজের চর্চা করা প্রয়োজন। তেমনি মানুষের প্রকৃত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য ব্যবসামুক্ত স্বাস্থ্যসেবা পরিচর্যা করা প্রয়োজন। ব্যবসামুক্ত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে একদিকে যেমন সামাজিক নিরাপত্তা তৈরি হবে, তেমনি সকল শ্রেণির মানুষের জন্য প্রকৃত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

ব্যবসামুক্ত স্বাস্থ্যসেবা বলতে স্বাস্থ্য সেবার সাথে লাভের কোন সম্পর্ক থাকবে না। এজন্য সরকার ও অলাভজনক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু ব্যবসামুক্ত স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে একেক দেশ একেক নীতি অবলম্বন করতে পারে। তবে মূল নীতি (প্রিন্সিপল) থাকবে ব্যবসামুক্ত জনকল্যাণকর টেকসই স্বাস্থ্যসেবা, যার সাথে মুনাফার কোন সম্পর্ক থাকবে না।

আমরা যদি বিশ্বকে, রাষ্ট্রকে ও সমাজকে সুখময় করে গড়ে তুলতে চাই তাহলে স্বাস্থ্যকে সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে। কথায় বলে, “স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল।” তাই সুখী-সমৃদ্ধ টেকসই রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের জন্য স্বাস্থ্যক সবার ওপরে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
পৃথিবী তখনই স্থির থাকে, যখনই বড় কোন রোগ-ব্যধি ও মহামারী থেকে পৃথিবী দূরে থাকে।

মহামারী করোনা দিয়ে পৃথিবীর বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, মহামারী করোনাও পৃথিবীর মানুষকে স্বাস্থ্যগুরুত্ব নতুন করে বুঝাতে ও স্বাস্থ্যখাতের দূর্বল দিক চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে এবং স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়ে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। মানুষ মানুষের জন্য- এ গানের শ্লোগানে মানুষের মাঝে মানবিকতা জাগ্রত করে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ ও ব্যবসামুক্ত স্বাস্থ্যসেবার নতুন পথের পরিকল্পনা উন্মুক্ত আলোতে নিয়ে আসতে হবে।

অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যসেবার জন্য পূর্বের তত্ত¡কে শ্রেফ ডাটা হিসেবে বিবেচনা করে নতুন বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা ও ফরমোলা আবিষ্কার করতে হবে এবং নতুন ফরমোলায় মানবিক সেবাসমূহ বাস্তবে প্রয়োগ করে দারিদ্র্য ও স্বাস্থ্যহীনতা থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে হবে। মানুষকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান সামাজিক নিরাপত্তাসহ অতি মৌলিক বিষয়সমূহ নিশ্চিত করতে পারলে দ্রæত দারিদ্র্য হ্রাস করা সম্ভব। এটিই সর্বোত্তম পন্থা হতে পারে। তাই এ বিষয়গুলো কার্যকরের জন্য কার্যকর পরিকল্পনা প্রয়োজন।

মহামারী করোনার পরবর্তী বিশ্বমানবিকতা, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যের হ্রাস, দারিদ্র্য বিমোচন, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তন, মহৎ মানুষের সৃষ্টি ও মানব সেবায় মানবিক প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি ও বৈষম্যমুক্ত এক বিশ্ব গড়ে ওঠার অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। আর এই অপার সম্ভাবনায় ক্ষণে বিশ্ব নেতৃত্ববৃন্দ, বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ীসহ সকল শ্রেণিকে এগিয়ে আসতে হবে ‘সবার ওপর মানুষ সত্য’ এই শ্লোগানকে সামনে রেখে।

বর্ডার দিয়ে দেশ বিভক্ত হলেও করোনা মহামারী দেখিয়ে দিয়েছে এই বিশ্বের সকল জনবল এক বিশ্বের নাগরিক। তাই এক দেশের শিশু তিন বেলা পেট ভরে খাবে আর এক দেশের শিশু ক্ষুধার্থ থাকবে, এক দেশের শিশু স্বাস্থ্যসেবা পাবে আর এক দেশের শিশু বিনা চিকিৎসায় অসুখে ভুগে মাতা-পিতার সামনে মৃত্যুবরণ করবে অথবা পুষ্টিহীণভাবে বেড়ে উঠবে যা চরম বৈষম্য ও অমানবিক। আজ বিশ্বের নাগরিক এই বৈষম্য ও চরম অমানবিকতা থেকে মুক্তি চায় । তাই বিশ্ব নেতৃত্ববৃন্দকে এ বৈষম্য দূরীকরণে এক হয়ে কাজ করতে হবে।

বিশ্বের বড় বড় নামী-দামী বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল বিষয়ে পড়ানো হয়। সময়ের সাথে সাথে নতুন বিষয়ের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু মানবিকতা বৃদ্ধি বা সৃষ্টির জন্য কোন বিষয় বা বিভাগ চালু করা হয়নি, যা সবার আগে প্রয়োজন। সমাজে অনেক বড় বড় ধনী শ্রেণির সৃষ্টি হয়। কিন্তু শিক্ষিত ও ধনী মানুষগুলো অমানবিক হয়ে গড়ে উঠেছে। ফলে সমাজে কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যানকর কর্মকান্ড ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে।

মানবিকতা সৃষ্টি করতে পারলে বিশ্বের সকল বৈষম্য ও বড় বড় সমস্যার সমাধান খুব সহজেই করা সম্ভব। কোন দেশ দারিদ্র্য বিমোচনে কতটুকু অবদান রাখলো, সেটা ওই দেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা কতটুকু উন্নত সেটা দেখে সহজেই বোঝা যায়। তাই দেশের সার্বিক উন্নয়নের সাথে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন জড়িত।

দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, নারী ও শিশুদের উন্নয়ন সামাজিক নিরাপত্তাসহ কর্মসূচিসমূহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই সাথে বিদ্যুৎশক্তি, তথ্যপ্রযুক্তি, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অবকাঠামোও গুরুত্বপূর্ণ। তবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও কৃষিতে উন্নয়ন সাধন করে অন্যান্য বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে। অন্যথায় সকল উন্নয়ন স্মার্টলেস চাকচিক্যে পরিণত হবে।

কিন্তু আমরা যদি আক্ষরিক অর্থে শিক্ষিত ও মানবতাহীন অমার্জিত ধনী শ্রেণী তৈরি করি তাহলে দেখা যাবে যে, শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে সুন্দর রাস্তা ও অট্টালিকা তৈরি হবে। যেখানে বাস করবে ও রাস্তা দিয়ে চলালল করবে বিবেকবর্জীত অমানবিক মানুষ। যার অর্থ দাঁড়ায় সুন্দর বাড়ি, সুন্দর রাস্তা, সুন্দর গাড়ি আর অসুন্দর মানুষ; যাদের কাছে প্রতারণা আর বিকেকবর্জিত কর্ম ছাড়া কখনও রাষ্ট্রের কল্যাণকর কোন কিছু পাওয়া সম্ভব নয়।

তাই সুন্দর জাতি গঠনের জন্য সুন্দর মনের রুচিশীল, মার্জিত ও মানবিক মানুষ দরকার। এ জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, শিশু ও নারীর উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, অবকাঠামো ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি অতি মৌলিক বিবেচনা করে পরিকল্পনা নিয়ে প্রকল্প গ্রহণ করা আবশ্যক। অন্যথায় সমাজে অসুন্দর ও অমানবিক এক শ্রেণির ধনবান গোষ্ঠীর সৃষ্টি হবে।

কোন শিশুর জন্মগত পিতা-মাতা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে পিতামাতা শুধু শিশুর পালনকর্তা। প্রতিটা শিশু রাষ্ট্রের অমূল্য সম্পদ। কারণ প্রতিটি শিশু বড় হয়ে সে রাষ্ট্রের সেবা করে। একটি শিশু বড় হয়ে যদি কৃষক হয়, তাহলে রাষ্ট্রের জনগণের জন্য শস্য ফলায়, খাদ্য উৎপাদন করে। আবার যদি ডাক্তার হয় তাহলে রাষ্ট্রের জনগণের চিকিৎসা সেবা দেয়।

যদি রাষ্ট্রের কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়, তাহলে সে দেশের মানুষের সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাই প্রতিটা শিশুকে রাষ্ট্রের অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে রাষ্ট্রকে সকল শিশুর দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। তাহলে রাষ্ট্রের তত্ত¡াবধানে পালিত অধিকাংশ শিশু রাষ্ট্রের দক্ষ ও মানবিক জনশক্তিতে রূপান্তরিত হবে। ফলে দেশ একটি উন্নত ও শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হবে। তাই শিশুর স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়ে বিনিয়োগ রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করবে।

ব্যক্তি উদ্যোগে মানবিক সেবাসমূহ তৈরি করে যখন কোন সংস্থার জন্ম হয় তখন তাকে আমরা মানবিক অলাভজনক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিসাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি। মহৎ কোন ব্যক্তির হাত ধরে অলাভজনক বেসরকারি সেবামূলক সংস্থার জন্ম হয়। যখন কোন দেশে মহৎ ও মানবিক ব্যক্তির সংখ্যা লোপ পায় তখন এ ধরনের সেবামূলক সংস্থা হ্রাস পায়। আবার মহৎ ব্যক্তিদের হাত ধরে কিছু অলাভজনক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জন্ম নিলেও তাদের মৃত্যুর পরে প্রতিষ্ঠান যোগ্য মানবিক নেতৃত্বের অভাবে প্রতিষ্ঠানটি মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পরবর্তীতে জনগণকে সেবা থেকে বঞ্চিত করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়।

বর্তমান বিশ্বে এই ধরনের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তারা যে মানবিক সেবাকে লক্ষ্য করে গড়ে উঠেছিল তা থেকে বিচ্যুত হয়ে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্টরা লাভবান হয়েছেন। কিন্তু দরিদ্রের দারিদ্র্য বিমোচন ও মানুষের সেবা থেকে অনেক দূরে সরে গিয়ে আচার-আচরণে ও বাস্তবে কর্পোরেট ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। কোন অলাভজনক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবসমূহ পর্যবেক্ষণ করলে খুব সহজেই বোঝা যাবে প্রতিষ্ঠানটি মানবিক সেবায় নিয়োজিত নাকি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে।

যেমন গুরুত্বপূর্ণ মানবিক সেবা বলতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও শিশুকে প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করতে পারি। যদি কোন প্রতিষ্ঠান নিজস্ব হাসপাতালের মাধ্যমে নামমাত্র মূল্যে অথবা বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির মাধ্যমে নামমাত্র মূল্যে কোয়ালিটি শিক্ষা দিয়ে থাকে, তাহলে ধওে নেওয়া যায় প্রতিষ্ঠানটি তার প্রকৃত লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে। আর যদি কোন প্রতিষ্ঠান নামমাত্র সেবার নামে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জনসেবার নামে প্রতারণা কওে, তাহলে বুঝতে হবে মানব সেবার নামে বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। সে জন্য শক্তিশালী মানবিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির লক্ষ্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম মূল্যায়ন করা প্রয়োজন এবং কোন অলাভজনক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে অর্জিত আয় সরাসরি স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও দারিদ্র বিমোচন খাতে ব্যয় হচ্ছে কিনা, তা পরিবীক্ষণ করা প্রয়োজন।

শক্তিশালী অলাভজনক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির জন্য সময়ে সময়ে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। কখনো ধনাঢ্য মানবিক ব্যক্তিদের উৎসাহের মাধ্যমে, কখনও সরকারি বড় বড় প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে পুঁজি গঠন করে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালনার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কারণ সরকারের পাশাপাশি সহায়ক শক্তি হিসেবে শক্তিশালী বেসরকারি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ছাড়া মানবিক সেবা সৃষ্টি সম্ভব নয়। সরকার তথা জনগণের অর্থে সৃষ্ট জনগণের জন্য প্রতিষ্ঠিত অলাভজনক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যোগ্য মানবিক নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে পারলে সত্যিকারের সেবা তৈরি করা সহজ হবে এবং জনগণের প্রকৃত সেবার সুযোগ সৃষ্টি হবে। রাষ্ট্রও শক্তিশালী রূপে প্রতিষ্ঠিত হবে।

একটি বিষয় আমাদের মনে প্রাণে ধারণ করা প্রয়োজন, তা হলো ‘যে বিষয়ের ওপর আমরা উন্নতি করতে চাই সেই বিষয়ের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা প্রয়োজন।’ যেমন আমরা যদি আইটিতে উন্নতি করতে চাই তাহলে আইটি বিষয়ে আইটি বিশ্ববিদ্যালয়, মহাকাশ বিদ্যায় উন্নতি করতে চাইলে মহাকাশ বিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয়, দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য দারিদ্র বিমোচন বিশ্ববিদ্যালয়, মানবিক মানুষ তৈরির জন্য মানবিক বিশ্ববিদ্যালয়, স্বাস্থ্য বিষয়ে উন্নতি করার জন্য মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি ‘পাবলিক হেল্থ বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপন করা প্রয়োজন ।

মানুষের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন মানুষ তৈরির জন্য প্রতিটি রাষ্ট্রে মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পাশাপাশি আবশ্যিকভাবে একটি ‘স্বাস্থ্য টিভি’ ও একটি “পাবলিক হেল্থ বিশ্ববিদ্যালয়” স্থাপন করা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য টিভির মাধ্যমে স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনমূলক প্রোগ্রাম প্রচার করে জনগণকে স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন করে জনগণের অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ একটি সুস্থ-সবল জাতি গঠন করা সম্ভব। আর তাই উদ্ভাবনী জনকল্যাণমূলক আইডিয়া ‘স্বাস্থ্য টিভি’ বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে ও আবশ্যিকভাবে একটি সুস্থ্য-সবল জাতি গঠনে এবং স্বাস্থ্য নিরাপত্তার অমূল্য উদ্ভাবনী আইডিয়া হিসেবে কাজ করবে, যা একটি পাবলিক হেল্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকেও অনেক বেশি কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে।

ইতিমধ্যে এ বিষয়ে ‘স্বাস্থ্য টিভি ও বাংলাদেশ’ নামক গবেষণামূলক একটি বই প্রকাশিত হয়েছে যা দেশে-বিদেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী উপাদান হলো তথ্য। তথ্য থেকে দ্বিতীয় কোন শক্তিশালী বস্তু নেই। তাই স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনমূলক তথ্য জনগণকে স্বাস্থ্যশিক্ষায় ও জ্ঞানে শক্তিশালী করবে, যা শুধু স্বাস্থ্য টিভির মাধ্যমে সম্ভব। পাবলিক হেল্থ বিশ্ববিদ্যালয় একটি দেশের স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় শক্তিশালী দক্ষ জনবল তৈরি করবে এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। স্বাস্থ্য নিরাপত্তাকে সামনে রেখে এবং স্বাস্থ্য গুরুত্ব বিবেচনা করে আবশ্যিকভাবে পাবলিক হেল্থ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে।

মানবিক নেতৃত্ব ছাড়া দরিদ্র দেশগুলোর দারিদ্র্য বিমোচন কোন অর্থনৈতিক তত্ত¡ দ্বারা সম্ভব নয়। যতদিন দরিদ্র মানুষগুলোর দারিদ্র্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মানবিক জীবনযাপন, তাদের শিশুদের ক্ষুধায় ভরা পেট, পুষ্টিহীন স্বাস্থ্য, বিনা চিকিৎসায় অকাল মৃত্যু, ক্ষুধার তাড়নায় শিশুশ্রম, শিক্ষা বঞ্চিত হয়ে গড়ে ওঠা- এ বিষয়গুলো রাজনৈতিক মানবিক নেতৃবৃন্দের হৃদয়ে কঠিনভাবে নাড়া না দিবে এবং মানবিক নেতৃত্বের সৃষ্টি না হবে ততোদিন শুধু অর্থনৈতিক তত্ত¡ দ্বারা দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে দরিদ্র জনগণের মুক্তির কোন পথ পাওয়া সম্ভব নয়। এজন্য দারিদ্র্যে মুক্তির একটাই পথ মানবিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব।

স্বাস্থ্য নিপত্তার সাথে দারিদ্র্য বিমোচন অতপ্রতোভাবে জড়িত। তাই দারিদ্র্যে বিমোচনের জন্য মানুষের সার্বজনীন স্বাস্থ্য নিরাপত্তা যেমন নিশ্চিত করতে হবে তেমটি দারিদ্র্য বিমোচনে শিক্ষা, কর্মসংস্থানসহ অন্যান্য বিষয়গুলো প্রাধিকার হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। একটি অর্থনৈতিক তত্ত¡ হলো একটি পরিকল্পনার ধারণা। তাই মানবিক নেতৃত্বকে পৃথিবীর সামনে নিয়ে আসতে হবে এবং বিশ্বের দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে মানবিক নেতৃত্বকেই আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু হতে হবে এবং অর্থনৈতিক তত্ত¡গুলো দারিদ্র্য বিমোচনে মানবিক নেতৃত্বের সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করতে পারে।

দারিদ্র বিমোচনের প্রধান উপাদানগুলো হলো স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, কর্মসংস্থান, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, যোগাযোগ, অবকাঠামো, নারী ও শিশু উন্নয়ন। এ উপাদানগুলোর কার্যকর উন্নয়ন যতো বেশি সম্ভব ততো বেশি দ্রæত টেকসই দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব, যা সর্ম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে মানবিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর। দারিদ্র্য বিমোচন অর্থনৈতিক তত্তে¡র কোন বিষয় নয়, এটি মানবিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিষয়। মানবিক নেতৃত্বকে দূরে সরিয়ে কোন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বা তত্ত¡ দারিদ্র বিমোচনে কোন অবদান রাখতে পারবে না। যা বর্তমান দরিদ্র দেশগুলোকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে অনুধাবন করা যাবে। তাই মানবিক নেতৃত্বের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের পথ সুগম করতে হবে; বিকল্প অন্য কোন সমাধান নেই।

তবে মানবিক নেতৃত্ব দারিদ্র্য বিমোচনসহ আর কোন কোন সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে সেগুলোর ওপর উচ্চতর গবেষণার প্রয়োজন যা অর্থনীতিবিদসহ অন্যান্য গবেষকদের গবেষণার বিষয় হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ; যদি কোন দেশে দারিদ্র হ্রাস পায় সেটা ওই দেশের মানবিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও দরিদ্র মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে সম্ভব হয়েছে। এটি বিশ্বের যে কোন দারিদ্র্য হ্রাসকারী দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।

তাই দারিদ্র্য বিমোচন, ব্যক্তি স্বাস্থ্য নিশ্চয়তা, পরিবারের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, সুস্থ্য-সবল জাতি গঠন, মা ও শিশু স্বাস্থ্য উন্নয়ন, মানবিকতা সৃষ্টি, অর্থনৈতিক নিরপত্তা, জাতির উন্নয়ন এবং জনগণের স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করে মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হবে।

মো. জিয়াউর রহমান
লেখক: গবেষক ও
উপ-সচিব, ইসলামিক ফাউন্ডেশন। zia.rahman14@yahoo.com