ঢাকা, শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

ভ্যাকসিন সংকটে ভারত, শতাধিক সেন্টার বন্ধ

বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ টিকা উৎপাদনকারী দেশ ভারতে কোভিড ভ্যাকসিনের সংকট চরম আকার ধারণ করেছে।
দেশটির পুনেতে অবস্থিত সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কোভিশিল্ডের জোগানে ভাটা পড়েছিল আগেই। বুধবার দিল্লির রাজ্য সরকারও অভিযোগ করেছে, কোভ্যাকসিনের নির্মাতা ভারত বায়োটেকও তাদের নতুন করে আর টিকা দিতে পারবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। এর ফলে দিল্লিতে শতাধিক ভ্যাকসিন সেন্টার বন্ধ করে দিতে হয়েছে।

রাজধানী দিল্লি ছাড়াও ভারতের নানা প্রান্তে টিকা-প্রত্যাশীরা অ্যাপে বুকিং পাচ্ছেন না, টিকাকেন্দ্রে গিয়েও তাদের হতাশ হয়ে ফিরতে হচ্ছে বা চূড়ান্ত নাকাল হতে হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠছে।

গত ১৬ জানুয়ারি ভারতে মহাধূমধামে যে বিশাল টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়েছিল, ১০০ দিন যেতে না যেতেই সেই কর্মসূচি কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে।

প্রথম দুই-আড়াই মাসে ভারত প্রায় ৭০টি দেশে সাড়ে ছয় কোটির মতো ভ্যাকসিন রফতানিও করেছিল। কিন্তু পরে রফতানি বন্ধ করে দিলেও দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদাও এখন কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না।

ভ্যাকসিন সংগ্রহের জন্য দেশের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে কার্যত প্রতিযোগিতাও শুরু হয়ে গেছে। আর এরইমধ্যে দিল্লির আম আদমি পার্টির সরকার অভিযোগ করেছে, কেন্দ্রের নির্দেশেই ভারত বায়োটেক তাদের কোভ্যাকসিন পাঠাতে অস্বীকার করেছে।

দিল্লির উপমুখ্যমন্ত্রী মনীশ শিশোদিয়া বুধবার জরুরি সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘কোভ্যাকসিনের নির্মাতা সংস্থা আমাদের চিঠি লিখে সরাসরি জানিয়ে দিয়েছে, তারা দিল্লিকে টিকা দিতে পারবে না। কারণ তাদের কাছে দেওয়ার মতো নাকি কোনও টিকাই নেই।’

শিশোদিয়া আরও অভিযোগ করেন, কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তারাই এই টিকার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করছেন আর তাদের বিমাতাসুলভ আচরণের কারণেই দিল্লিতে কোভ্যাকসিনের শতাধিক টিকা কেন্দ্র বন্ধ করে দিতে তারা বাধ্য হচ্ছেন।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পাল্টা সাংবাদিক সম্মেলন ডাকেন বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র সম্বিত পাত্র। তার দাবি, টিকার জোগান বাড়ানোর জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে ফর্মুলা দিয়ে টিকা বানানোর নির্দেশও দেয়া হয়েছে।

সম্বিত পাত্র জানান, ‘মহারাষ্ট্রের হ্যাফকিন বায়োফার্মা, ইন্ডিয়ান ইমিউনোলজিক্যাল লিমিটেড, ভারত ইমিউনোলজিক্যালস এ রকম তিন-চারটি সরকারি সংস্থাকে কেন্দ্র কোভ্যাকসিন বানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিএমআর-ও নানা সংস্থার সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা বলছে তোমরা আমাদের কাছ থেকে ফর্মুলা নাও, টিকা বানাও।’

ভ্যাকসিনের জোগান নিয়ে বিজেপি রাজনীতি বন্ধ করার আহ্বান জানালেও টিকা পেতে সাধারণ নাগরিকরা যে নাজেহাল হচ্ছেন, তাতে কিন্তু কোনও ভুল নেই। কোউইন নামে যে সরকারি অ্যাপে রেজিস্ট্রেশন করে টিকার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়ার কথা সেখানেও স্লট মিলছে না। আবার সাতসকালে টিকাকেন্দ্রে ওয়াক-ইন করেও নিরাশ হতে হচ্ছে বহু মানুষকে।

পশ্চিমবঙ্গে হলদিয়ার একটি টিকাকেন্দ্রে গত সপ্তাহে এমনই অভিজ্ঞতা হয়েছিল সীমা ঘোষালের। সকাল পৌনে ৬টার সময় টিকা কেন্দ্রে পৌঁছেও তিনি শোনেন, সর্বোচ্চ যে ১৩০ জনকে সেদিন টিকা দেওয়া যাবে তাদের সবার নাম নাকি লেখা হয়ে গেছে। ফলে তার আর সেদিন সুযোগ মিলবে না।

সীমা ঘোষালের ভাষায়, ‘অতো সকালেও এসে শুনি ১৫০ জনের বেশি নাকি নাম লেখা হয়ে গেছে! অথচ তখন সেখানে মাত্র পাঁচ-সাতজন দাঁড়িয়েছিল। সেন্টারের গেটও বন্ধ। তাহলে কারা নাম লিখল? কাদের নাম লিখল? আর তারা গেলই বা কোথায়, তাতো কিছুই বুঝতে পারছি না!’

আবার টিকাকেন্দ্রগুলোতে উপচেপড়া ভিড়, ঘেঁষাঘেঁষি লাইনের জন্যই সংক্রমণের ভয় পাচ্ছিলেন সীমা ঘোষালের প্রতিবেশী আলো বণিক। টিকাকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে তিনি বলছিলেন, ‘এতো ভিড় ঠেলে কেন ভ্যাকসিন নিতে ঢুকবো বলুন তো? করোনার ভ্যাকসিন নিতে এসেই যদি এই গাদাগাদি ভিড়ে করোনায় আক্রান্ত হই, তার চেয়ে তো বাড়িতে বসে থাকাই ভালো।’

ভারতের বৃহত্তম বায়োফার্মা কোম্পানি বায়োকনের কর্ণধার কিরণ মজুমদার শ-ও সরাসরি বলছেন, ‘ভারতে টিকাদানের গতি যে হারে কমছে তাতে আমি রীতিমতো উদ্বিগ্ন বোধ করছি। বহু সেন্টারে টিকার জোগান আসছে না। আবার কোনও কোনও সেন্টার তাদের নির্ধারিত কোটাই দিয়ে উঠতে পারছে না। কোথাও তো কিছু একটা ভুল হচ্ছেই।’

তার প্রশ্ন, জানুয়ারিতে ভ্যাকসিন অনুমোদন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেন আমরা নির্মাতা সংস্থাগুলোকে অর্ডার দেইনি? চাহিদার হিসেব কষে কেন সাপ্লাই শিডিউল তৈরি করিনি?

টিকাদান কর্মসূচির অঙ্কগুলো কষার ক্ষেত্রে মোদি সরকারের হিসাবে ও পরিকল্পনায় যে মারাত্মক ভুল হয়েছিল, সেটা ভারতে আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট। তার মধ্যে প্রথম দিকে ৭০টি দেশে টিকা পাঠিয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলা হয়েছে, দিল্লিতে আম আদমি পার্টির সরকার-সহ অনেকেই এখন এমন অভিযোগ তুলছেন।

সূত্র: বিবিসি